এক সময় পর্যাপ্ত উৎপাদন ও ডিলারের মাধ্যমে দেশব্যাপী সরবরাহের মাধ্যমে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে একদমই উল্টো চিত্র। উৎপাদন অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানি না করায় মজুদ তলানিতে নেমেছে প্রতিষ্ঠানটির। ফলে এখন বিএসএফআইসি চিনির দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ ৩ নভেম্বর বিএসএফআইসি চিনির মিলগেটের মূল্য কেজি ৭৪ টাকা থেকে ১১ টাকা বাড়িয়ে ৮৫ টাকা করে। ডিলার পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য সমপরিমাণ বাড়িয়ে ৮৭ টাকা করা হয়। এছাড়া সরকারি মিলে উৎপাদিত মোড়কজাত চিনি মিলগেটে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকা এবং করপোরেট সুপারশপ ও চিনিশিল্প ভবনের বেজমেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১৭ টাকা বাড়িয়ে কেজিপ্রতি ৯২ টাকা করা হয়। এছাড়া মোড়কজাত চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কেজিপ্রতি ৮৫ টাকা থেকে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ৯৯ টাকা করা হয়। যদিও ওই সময় দেশে বেসরকারি মিলগুলোয় প্রশাসনের অভিযান ও বাজার তদারকির কারণে দাম মণপ্রতি কয়েকশ টাকা পর্যন্ত কমেছিল। কিন্তু সরকারি মিলের চিনির দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর মণপ্রতি তা (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অন্তত ৬০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৪ হাজার ২০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
বিএসএফআইসি সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে চিনির মজুদ রয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩০০ টন। সীমিত পরিসরে মোড়কজাত চিনি নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, আনসার, ফায়ার সার্ভিসসহ মিলস রেশনে সরবরাহ করা হচ্ছে। সংরক্ষিত খাতে প্রতি বছর প্রায় ৩৫ হাজার টন চিনির চাহিদা থাকলেও কয়েক মাস ধরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বিভাগকে চিনি দিতে পারছে না বিএসএফআইসি। এমন পরিস্থিতিতে বিএসএফআইসির চিনির দাম পুনর্নির্ধারণের কারণে দেশীয় চিনির বাজার ফের অস্থির হয়ে উঠেছে। সোমবার দেশের অন্যতম প্রধান ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে চিনি কার্যত উধাও হয়ে যায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে চিনির মজুদ রয়েছে তারা মণপ্রতি চিনি ৪ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। যদিও কয়েক দিন আগেও পাইকারি বাজারে চিনির দাম মণপ্রতি প্রায় ৩০০ টাকা কমে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকায় নেমে এসেছিল।
বাজার অস্থিতিশীলতায় বিএসএফআইসির দাম পুনর্নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে কিনা জানতে চাইলে করপোরেশনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মাযহার উল হক খান বণিক বার্তাকে বলেন, বিএসএফআইসি সব সময় দেশের চিনির বাজারে স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখত। কিন্তু সম্প্রতি সরকারি চিনির মজুদ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বেসরকারি পর্যায়ে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিএসএফআইসির বিক্রি করা মোড়কজাত ও খোলা চিনির চাহিদা বেড়ে যায়। আগের কম দামের কারণে বিক্রয় কেন্দ্রগুলোয় দীর্ঘ লাইন লেগে যেত। ফলে বাধ্য হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে চিনির দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তবে চিনির বাজারে অস্থিতিশীলতার পেছনে বিএসএফআইসির দাম পুনর্নির্ধারণের ভূমিকার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
বাংলাদেশ চিনি ডিলার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশীয় চিনির বাজারে বড় ভূমিকা ছিল চিনি শিল্প করপোরেশনের। কিন্তু উৎপাদন ঘাটতির পাশাপাশি অন্যায্য দাম নির্ধারণের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ডিলার ছাড়াও ব্যবসায়ীদের কাছে আস্থা হারিয়েছে। চিনি শিল্প করপোরেশনের দাম বাড়ানোর ঘটনায় পাইকারি বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। সরকারের উচিত করপোরেশনের সক্ষমতা বাড়িয়ে সবগুলো মিলের উৎপাদন চালু করা। পাশাপাশি আপত্কালীন চিনি আমদানির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করতে করপোরেশনকে শক্তিশালী করা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসএফআইসির পরিকল্পনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, অন্তত ছয় মাস আগেই সরকারি উদ্যোগে চিনি আমদানির প্রস্তাব দিয়েছিল বিএসএফআইসি। কিন্তু করপোরেশনের এ প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বিশ্ববাজার, দেশীয় মজুদ ও আমদানি চিত্র পর্যালোচনা করে সংকটের বিষয়টি অনেক আগেই অনুধাবন করেছে বিএসএফআইসি। কিন্তু ছয়টি চিনিকল বন্ধ রাখার পাশাপাশি আমদানির সুযোগ না দেয়ায় দেশীয় বাজারে চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে।